টমাস এডিসনের জীবনী: ছোট্ট ছেলের কৌতূহল থেকে ১০৯৩টি আবিষ্কার

Thomas Alva Edison

যখন টমাস আলভা এডিসন ছোট ছিলেন, তখন তাঁকে বলা হত গাধা।  তার শারীরিক অবস্থাও খুব সুবিধার ছিল না।  ছোটবেলা থেকেই তাঁর দেহে ছিল নানা ধরনের রোগব্যাধি।  অথচ এই তথা কথিত পিছিয়ে পড়া ছেলেটি এক সময় হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী।  টমাস আলভা এডিসনের জীবনটা থ্রিলার সিনেমার মতো।
 আমেরিকার ছোট্ট মিলান শহর ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শীতের নরম সকালে পৃথিবীর আলো দেখল এক বিস্ময় বালক।  নাম রাখা হল টমাস আলভা এডিসন।  ছোটবেলা থেকেই তার চোখ জুড়ে ছিল অসীম জিজ্ঞাসা।  অন্য শিশুর মতো কেবল খেলাধুলায় মেতে থাকার পাত্র তিনি ছিলেন না।  তাঁর মনের মধ্যে ছিল কেন আর কীভাবে—এমন প্রশ্ন।  একবার তিনি একটি রাজহাঁসকে ডিমে তা দিতে দেখে, তাঁর ছোট্ট মনে খেলে গেল এক অভিনব বুদ্ধি।  সেও কিছু ডিম জোগাড় করে বসে পড়ল সেগুলোর উপর, শুধু এটা দেখতে যে সত্যিই বাচ্চা ফুটে কি না।
 আরেকবার তার কৌতূহল আগুনে ধরিয়ে দিল বাবার গুদামঘরে চুপিসারে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে।  চলছিল তাঁর গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।  কিন্তু এক অসতর্ক মুহূর্তে দাউদাউ করে আগুন লেগে গেল।  বাবা এতটাই ক্ষিপ্ত হলেন যে প্রায় তাঁকে পিটিয়ে মারার চেষ্টা করেছিলেন।  কিন্তু নতুন কিছু পরীক্ষা করার নেশা কমল না।
 এডিসনের স্কুলে তার কপালে জুটে ছিল “ইডিয়ট” তকমা।  শিক্ষকরা তার পারফরম্যান্সে হতাশ হয়ে বাধ্য হলেন তার মাকে ডেকে বলতে, “আপনার ছেলে স্কুলের পড়াশোনা ঠিকভাবে করতে পারবে না।”  কিন্তু টমাসের মা, ন্যান্সি এলিয়ট এডিসন, বিশ্বাস করতেন না যে তার ছেলে একজন ইডিয়ট।  তিনি ছেলেকে স্কুলের চাক থেকে মুক্ত করে নিজেই শিক্ষার দায়িত্ব নিলেন।  ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান সব কিছুই তিনি একাই শিখিয়েছেন।
 মায়ের উৎসাহে টমাস বিজ্ঞানের প্রতি ভীষণ মনোযোগী হয়ে উঠলেন।  সাথে সেই অল্প বয়সেই ছোট ছোট আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন।  টমাসের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না।  মাত্র ১২ বছর বয়সে টমাস জীবিকার তাগিদে ট্রেনে সংবাদপত্র ও নাশতা বিক্রি শুরু করলেন।  একবার কাজ করতে গিয়ে প্রায় চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে গিয়েছিলেন।  সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও মারাত্মক আঘাতের ফলে তার শ্রবণ শক্তি আংশিকভাবে নষ্ট হয়ে যায়।
 কিন্তু এডিসন ছিলেন ব্যতিক্রমী।  তিনি পরে দাবি করেন যে, এই শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ায় তার মনোযোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।  ট্রেনের লাগেজ কামরাতেই তিনি নিজের ছোট্ট ল্যাবরেটরি বানিয়েছিলেন।  সেখানেও গবেষণার সময় ভুলবশত আগুন লেগে গেলে তাঁকে ট্রেন থেকে বের করে দেওয়া হয়।
 একদিন এক নাটকীয় ঘটনা ঘটল – তিনি স্টেশন মাস্টারের শিশুপুত্রকে চলন্ত ট্রেন থেকে বাঁচালেন।  স্টেশন মাস্টার এতটাই খুশি হলেন যে পুরস্কার স্বরূপ তাকে টেলিগ্রাফ শেখালেন এবং টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে তার প্রথম চাকরিও দিলেন।
 এডিসন তার স্বভাবসুলভ জিজ্ঞাসু মন নিয়ে ক্রমাগত টেলিগ্রাফের নানা উন্নতি সাধন করতে থাকলেন।  এক সময় তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকেত পাঠানোর মেশিন তৈরি করে ফেললেন।  টেলিগ্রাফ সরঞ্জাম নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন রিপিটার।  কিন্তু বিপদ অপেক্ষা করছিল – তার সুপারভাইজারও একই বিষয়ে কাজ করছিল।  এডিসনের আবিষ্কারের কথা জানতে পেরে তাঁকে বরখাস্ত করা হলো।
 টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি হারানোর পর টমাস একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন।  কয়েকটা ছোটখাটো কাজও থিতু হল না।  বেকারত্ব এবং ক্রমবর্ধমান বধিরতা তাকে আরও কাবু করে ফেলেছিল।  ঠিক সেই সময়ে এক বন্ধু তাকে বোস্টনে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।  সেখানে তার গতি ও টেলিগ্রাফ সিস্টেম উন্নয়নের দক্ষতা সবার নজর কেড়েছিল।
 এর ফলে এডিসন মোটা অঙ্কের কমিশনও পেতে শুরু করলেন।  এবার সাহস করে তিনি ফুল টাইম ফ্রিল্যান্স উদ্ভাবক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।  এই সময়ে এডিসন তার প্রথম কৃত আবিষ্কার পেয়েছিলেন – একটি ভোট রেকর্ডার।  কিন্তু এটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়, কারণ আইনসভা এটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল।
 ডুপ্লেক্স টেলিগ্রাফ তৈরি করার চেষ্টা চলাকালীন তিনি প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলেন।  তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন – ফ্রাঙ্কলিন পোপের সহকারী হিসেবে কাজ পেলে, পোপের গোল্ড ইন্ডিকেটরে ত্রুটি দ্রুত ঠিক করতে সক্ষম হন।  এডিসন পদোন্নতি পেলেন এবং বেতনও বেড়ে গেল।
 এরপর ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন তাকে পেটেন্ট অধিকারের জন্য ৪০,০০০ ডলারের প্রস্তাব দিল, যা আজকের দিনে প্রায় এক মিলিয়নের সমান।  এই প্রস্তাব তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
 গবেষণাগার স্থাপন করে তিনি আরও অনেক আবিষ্কার চালিয়ে গেলেন।  ১৮৭৭ সালে তিনি ফোনোগ্রাফ আবিষ্কার করলেন।  এর ফলে সঙ্গীত শিল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
 পরবর্তীতে তিনি নিখুঁত আলোর বাল্ব আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু করলেন।  নানা ম্যাটেরিয়াল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কার্বনাইজড ফিলামেন্ট তৈরি করলেন, যা ৪০ ঘন্টা পর্যন্ত জ্বলে।  উন্নত করার পর এটি ১৭০ ঘন্টা পর্যন্ত জ্বলে।  নববর্ষের আগের রাতে মেনলো পার্ককে আলোকিত করে ৩০০০ দর্শককে ভবিষ্যতের ঝলক দেখালেন।
 ডি সি কারেন্ট ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করলেন।  নিকোলা টেসলার এসি কারেন্ট নিয়ে কাজ করছিলেন।  এডিসন টেসলার ধারণা মানতে চাইলেন না এবং প্রতারণার মাধ্যমে প্রচার যুদ্ধ শুরু করলেন।  ১৮৯২ সালের কলম্বিয়ান এক্সপোজিশনে এসি কারেন্টের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা প্রমাণিত হলো।
 আলোর বাল্বের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করা হলো।  জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি খ্যাতি লাভ করলো।  চলচ্চিত্র, প্রজেক্টর ও রেডিও প্রযুক্তিতেও অবদান রাখলেন।
 ১৯৩১ সালে তিনি তার ১০৯৩ তম পেটেন্ট ফাইল করলেন।  সেই বছর ৮৪ বছর বয়সে মারা যান।  এভাবেই শেষ হলো গাধা থেকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হওয়া এডিসনের জীবন।
 


 

Previous Post